চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে চূড়ান্ত করা হয়েছে বে-টার্মিনালের মাস্টারপ্ল্যান। এখন ডিটেইল ড্রইং ডিজাইনের কাজ চলছে। এটি শেষ হলে শিগগির প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে ২০১৫ সালে বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর আট বছর পার হয়ে গেলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি। তবে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত হওয়ায় বে-টার্মিনালের কাজ শুরু করতে এখন আর কোনো বাধা নেই।
দ্বিতীয় দফায় সংশোধনের পর প্রকল্পটির মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ১৪ নভেম্বর প্রকল্পটির চূড়ান্ত মাস্টারপ্ল্যানের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে প্রকল্পটি।
এ সম্পর্কে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বে-টার্মিনালের মাস্টারপ্ল্যান হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী এর মোড়ক উন্মোচন করেছেন। এখন শুধু কাজ শুরুর অপেক্ষা। আশা করছি, ২০২৬ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে। ২০২৭ সালে পুরোপুরি চালু হবে।’
২০১৫ সালে নগরীর ইপিজেড এলাকা থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনিঘাট পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের তীরে ৮৭০ একর জমিতে বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটির অধীনে প্রাথমিকভাবে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে একটি ১ হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল (কনটেইনার টার্মিনাল-১), একটি ৮৩০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল (কনটেইনার টার্মিনাল-২) এবং একটি ১ হাজার ৫০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। তিনটির মধ্যে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে করবে। বাকি দুটি নির্মাণে অর্থায়ন করবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, ‘বে-টার্মিনালটি নির্মাণের দাবি অনেক দিনের। নানা কারণে এই প্রকল্পটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটির মাস্টারপ্ল্যানের মোড়ক উন্মোচন করায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। আমরা আশা করছি, বে-টার্মিনাল প্রকল্পের আওতায় যে মাল্টিপারপাস শেডটি নির্মাণ করার কথা রয়েছে, সেটির কাজ দ্রুত শেষ হবে। এই কাজ শেষ হলে ওই টার্মিনাল থেকে বাল্ক এবং কার্গো– দুই ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে।’
বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর ২০১৭ সালে প্রকল্পটির প্রথম মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। ওই সময় মাস্টারপ্ল্যানের লে-আউটে তিনটি শেডের মধ্যে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল শেড মাস্টারপ্ল্যানে উত্তর প্রান্তে রাখা হয়। সেটিতে আবার পরিবর্তন আনা হয়। ২০২২ সালে আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি এবং ডাইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্ল্যান তৈরি করে। এই মাস্টারপ্ল্যানে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল শেড মাঝখানে রাখা হয়।
মাস্টারপ্ল্যানটি বন্দরের বোর্ড মিটিংয়ে পাস হওয়ার পর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মাস্টারপ্ল্যান নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী জুন মাসে ডিটেইল ড্রইং ডিজাইনিংয়ের কাজ শেষ করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ডিটেইল ড্রইং ডিজাইন চূড়ান্ত করার পূর্বে আগের মাস্টারপ্ল্যান রিভিউর নির্দেশনা দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় আগের মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ করে পুনরায় মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করা হয়। নতুন মাস্টারপ্ল্যানে মাল্টিপারপাস শেডটি পুনরায় উত্তরপ্রান্তে রাখা হয়। মাস্টারপ্ল্যানটি চূড়ান্ত করার পর প্রধানমন্ত্রী এটির মোড়ক উন্মোচন করেন। ২০১৬ সালে কারিগরি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সাত বছর পর বে-টার্মিনাল আলোর মুখ দেখছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল জানিয়েছেন, বে-টার্মিনালের মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত হয়েছে। দেশি-বিদেশি পরামর্শক এবং বিদেশি বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ ও অংশীদারদের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘বে-টার্মিনালটা আমাদের একটা স্বপ্ন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য অপেক্ষা করছি। দেশি-বিদেশি সবার মতামত নিয়ে আমরা অত্যন্ত চমৎকার একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছি। এটি বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট ও মডার্ন একটি টার্মিনাল হবে। আর টার্মিনাল বলা হলেও এটি আরেকটি বড় বন্দরের মতোই হবে। মোট কথা, এটি হবে বড় একটি বন্দর।’
বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ১০ থেকে ১২ মিটার ড্রাফটের ছয় হাজার কনটেইনার বহন ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ নোঙর করা সম্ভব হবে। বন্দরের বিদ্যমান অবকাঠামো জেটিতে সর্বোচ্চ ১৮০০ একক ধারণক্ষমতার কনটেইনার জাহাজ ঢুকতে পারে। এখন বন্দরে জোয়ার-ভাটার ওপর ভিত্তি করে জাহাজগুলো জেটিতে ভেড়ে। কিন্তু বে-টার্মিনালে ২৪ ঘণ্টাই জাহাজ ভিড়তে পারবে।
মাস্টারপ্ল্যানে বে-টার্মিনাল তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বিনিময়ে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হবে বলে আশা মিলেছে। ১৪ মিটারের বেশি প্রাকৃতিক গভীরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এই বে-টার্মিনাল নিয়ে। প্রস্তাবিত এই বন্দরে বিনিয়োগ করবে সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি এবং দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড। গভীরতা রক্ষায় ব্রেক ওয়াটার তৈরির প্রকল্পে ৫০ মিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক।
চূড়ান্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১ হাজার ২২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি জেটিতে অংশীদার হিসেবে থাকছে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড ও সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি। চট্টগ্রাম বন্দর ১৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণ করবে। দেশে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি এলপিজি ও এলএনজির মজুত সক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়ানোর টার্গেট নিয়ে বে-টার্মিনালে লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল এবং ডিপো স্থাপনের প্রস্তাবও পেয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান নৌবাণিজ্য সামাল দিতে হলে বাড়াতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা। বাড়াতে হবে টার্মিনালের সংখ্যা। বাড়াতে হবে দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতির সংখ্যাও। এসব চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বে-টার্মিনাল প্রকল্প। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুবিধার চেয়ে তিনগুণ বেশি সুবিধা এখানে পাবেন ব্যবসায়ীরা। তাই দ্রুত এটির মূল কাজ শুরু করা উচিত। মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত হওয়া একটি বড় অগ্রগতি। এখন শুরু করতে হবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।